নারীই হবে উন্নয়নের প্রধান শক্তি
স্বাধীনতার বায়ান্ন বছরে বাংলাদেশ দারিদ্র্যসীমা অতিক্রম করে ক্রমাগত উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। এই উন্নয়নের পেছনে নারী সমাজের অবদান অনেকখানি। বিশেষ করে নারী তার শ্রমের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপকভাবে সহায়তা করে আসছে। নারীরা যতোই শিক্ষিত ও কর্মশক্তিতে পরিণত হচ্ছে দেশ ততোই উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বাড়ছে নারীর ক্ষমতায়ন, কমছে দারিদ্র্যের হার। বর্তমানে দেশে দারিদ্র্যের হার ২০% এর নিচে নেমে এসেছে। গত কয়েক দশকের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম নিয়ামক তৈরি পোশাক শিল্পে নারীর রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এ ছাড়াও কৃষি, সেবা খাত, খামারবহির্ভূত কৃষি, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে নারীর বলিষ্ঠ ভূমিকা জাতীয় অর্থনীতিকে আরো বেগবান করেছে। অবশ্য আবহমানকাল ধরে নারীরা গৃহস্থালি কর্মে যে অবদান রেখে চলেছে তা অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখলেও অর্থনীতি এবং সামাজিক মানদণ্ডের বিচারে এখন পর্যন্ত অস্বীকৃত ও অপ্রদর্শিত। জাতীয় আয়ে নারীর ভূমিকা প্রায় ২৫% ধরা হয়ে থাকে। গৃহকর্মে নারীর এই অবদানের অর্থনৈতিক মূল্য ধরা হলে তাদের ভূমিকা ৫০% এরও বেশি হবে তাতে সন্দেহ নেই।
তবে বাংলাদেশের সার্বিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যে নারীদের অবদান অধিক গুরুত্বপূর্ণ তারা হলেন এনজিও/এমএফআইয়ের সদস্য এবং ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতা নারী। গ্রামীণ স্বল্পশিক্ষিত এই নারীরা ক্ষুদ্র অর্থায়নের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে রাখছেন বিশেষ অবদান। যে নারীরা একসময় ছিলেন হতদরিদ্র-পরিবার ও দেশের বোঝাস্বরূপ, সেই নারীরাই এখন কর্মশক্তিতে পরিণত হয়েছে। তারা আত্মকর্মসংস্থান ও কর্মসংস্থানের মাধ্যমে নিজেরাই শুধু স্বাবলম্বী হননি, জাতীয় উৎপাদনেও অবদান রাখতে সক্ষম হচ্ছেন। এই নারীরাই পরিবারের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, উন্নত পরিবেশের মাধ্যমে বদলে দিচ্ছেন সামাজিক জীবনযাত্রা। এভাবেই দেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হতে পেরেছে বলেই দেশের অবস্থান এখন উন্নয়নের সিঁড়িতে। অর্থাৎ সরকারের কল্যাণমুখী কর্মবলয়ের পাশাপাশি দেশের বেসরকারি শিল্প খাত, প্রবাসী রেমিটেন্স ও বেসরকারি উন্নয়ন খাতের ভূমিকা দেশকে স্থিতিশীল উন্নয়ন এনে দিয়েছে। এমএফআই খাতের মাধ্যমে দেশের প্রায় ৩ কোটি ৩০ লাখ পরিবার আর্থিক সেবার আওতায় এসেছে। যাদের মধ্যে ৯৬% নারী। ফলে লাখ লাখ নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টি হয়েছে। আশা করা যায়, ২০৩৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশে^ ২৪তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। এক্ষেত্রেও নারীর ভূমিকা ও অবদান অনস্বীকার্য।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশ খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ নয়। আয়তনে ছোট এ দেশটির অধিক জনসংখ্যা একসময় ছিল এ দেশের জন্য অভিশাপ। কিন্তু আজ এই জনসংখ্যাই জনসম্পদে পরিণত হতে চলেছে। অতীতে গৃহস্থালির কর্ম ছাড়া নারীরা অর্থনৈতিক কাজের সাথে সেভাবে সম্পৃক্ত হবার সুযোগ পায়নি। স্বামীর আয়ে স্ত্রী ও সন্তানদের ব্যয়ভার নির্বাহ হতো। এতে দরিদ্র মানুষ আরো হতদরিদ্র হয়ে পড়তো। কিন্তু এই নারীরা যখন থেকে কাজের মাধ্যমে অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হতে সক্ষম হয়েছে তখন থেকেই দেশের উন্নয়নের চাকা ঘুরতে শুরু করেছে। এতে পুরুষরা যেমন ভূমিকা রাখছে, তেমনি নারীরাও। কর্ম এবং শিক্ষা-দীক্ষা কোনো ক্ষেত্রেই এখন নারীরা পিছিয়ে নেই। দেশের রাজনৈতিক অভিভাবকত্ব ও কার্যক্রম থেকে শুরু করে প্রশাসনেও নারীরা আছেন স্বমহিমায়। সচিব থেকে শুরু করে সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সব পেশায় নারীর রয়েছে শক্ত অবস্থান। উদ্যোক্তা হিসেবেও শিল্প-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য এমনকি আইটি প্রফেশনেও এখন নারীর জয়জয়কার। দেশে প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদে নারীরা কর্মরত। সরকারি চাকরিজীবী ১৫ লাখ ৫৪ হাজার ৯২৭ জনের মধ্যে ৪ লাখ ৪ হাজার ৫৯১ জনই নারী। বিশ^বিদ্যালয়ে ভাইস চ্যান্সেলর পদে নারী, ব্যাংকিং সেক্টরে নারী ম্যানেজিং ডিরেক্টর, সেনাবাহিনীতে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, পুলিশ প্রশাসনে অতিরিক্ত আইজিপিসহ এমন কোনো কর্ম পেশা নেই যেখানে নারীর অবস্থান নেই। এমনকি বেসরকারি উন্নয়ন খাতের শীর্ষপদসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীরা দায়িত্ব পালন করছেন। নারীরা এভাবে এগিয়ে যেতে সক্ষম হলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে নারীরাই হবে উন্নয়নের প্রধান শক্তিÑ এটি নিশ্চিত করে বলা যায়।
বুরো বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত প্রত্যয় দেশের বেসরকারি উন্নয়ন খাতের মুখপত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। আমরা আশা করি দেশের সব পর্যায়ের এনজিও/এমএফআই তাদের উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের তথ্যনিষ্ঠ চিত্র প্রত্যয়ে প্রকাশের জন্য প্রেরণ করবেন। এ সংখ্যায় দেশের খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ, বেসরকারি উন্নয়ন খাতের প্রাজ্ঞ, অভিজ্ঞ নারী নির্বাহীবৃন্দসহ নারী রাজনীতিবিদ, ব্যাংকার ও উদ্যোক্তারা সাক্ষাৎকার প্রদান করে প্রত্যয় টিমকে সহযোগিতা করেছেনÑ তাদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।