নদী-দুহিতা
জরিনা আখতার
প্রিয় মাতৃভূমি, স্বদেশ আমার
তোমারও জননী আছে
তুমিও দুহিতা কারো
তুমি তো নদীমাতৃক,
নদীর স্তন্য পান করে
একটু একটু করে বেড়ে উঠেছ তুমি হাজার হাজার বছর ধরে,
পলিময় হয়েছে তোমার শরীর
একটু একটু করে লাবণ্যময়ী হয়েছÑ
আজ অপরূপ এক অনন্ত যৌবনা,
নির্ঝর পর্বত অরণ্যে শোভিত তুমি
নিসর্গের অলংকারে তুলনাহীনা;
ধরিত্রীর অপরিহার্য অঙ্গ তুমি
ধরিত্রীর মতোই সর্বংসহাÑ
এই যে তোমার মৃত্তিকা চষে নিংড়ে নিচ্ছি আমরা অমৃতের ভাণ্ডার,
জীবন ধারণ করছি তোমারই আচ্ছাদনে,
ষড়ঋতুর আবর্তনে নানা রূপে আবির্ভূতা তুমি,
আমাদের শূন্য জীবন ভরিয়ে দিয়েছ
তোমার অকৃপণ দানে,
তুমিই তপ্ত মরুভূমি, সজল মরুদ্যান
তুমিই দুপুরের খর রোদ, সন্ধ্যার শীতল প্রচ্ছায়া
পাখি ডাকা ভোরের স্নিগ্ধতা তুমিÑ
ঝিঁঝিপোকা ডাকা নিঝুম মধ্যরাতে
নিরুপদ্রব শান্তির ছায়াপথ।
দহনবেলা
সুবঙ্গমা ভট্টাচার্য
মায়া, বন্ধনসুখ আর ছাদের খিলানের তলায়
পাতা সংসারটি ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে যখন
চোখের সামনে হু হু পদ্মানদী
একবুক সমান জলের ওপর সাজানো পানসিতে
ছেলেটি একদিন বলেছিল আমি নির্জনতা পছন্দ করি
চিনচিন ব্যথায় তখন দহন
একটু পরেই গনগনে চাঁদ আগুন ছড়াবে
হই হই দোল নয় হোলির মাতোয়ারা সমাবেশে
আবির ও গজল ছুঁয়ে ডিজে বাজবে চাঁদোয়ার নীচে
অবধি আবহমান
রোকেয়া ইসলাম
তুমি বিহীন বসন্তবেলার এই পাট
নিয়মের করাত টানে ভাঙে
এই যে নৈমিত্তিক উদ্ঘাত
ভাংচুরের অভিঘাত
তার অবচেতন কতোটুকু বা কে জানে।
চৈত্রের তিস্তায়
শুকিয়ে যাওয়া অপলাপের নোনতা নিঃসরণ অথবা
ঝরে যাওয়া টুপটাপ রক্তক্ষরণ
আজ খুব প্রাসঙ্গিক;
বেখেয়াল বাতাসের অনুরণনের অতীত যাপন
বড়জোর এই উদাহরণ....
কেউ জানে না সীমান্ত কোথায়
কেউ চেনে না ধরনী প্রবহন পথ
জোয়ার-ভাটার নিরবধি বয়ে চলা জীবনে
মেনে নেই নি অন্যথা...
পথ চলতেই পথের খোঁজ
চমকে উঠি থমকে দাঁড়াই
নির্দ্বিধায় হররোজ।
অবধি আবহমানে
কেউ নেই আশেপাশে
কেউ নেই নিশ্বাসে
সেই একান্ত আপন;
তবুও অপার আগ্রহেই বয়ে যায়Ñ
নিদারুন অচেনা যাপন....
ফুসফুসে আঁকবো তোমায়
নাসরীন রশীদ
আজ আঁকবো তোমায়
চুল থেকে নখ, হাতের সিগারেটটাও,
ধুলোটে পাঞ্জাবি, কাঁধের ব্যাগ
অর্থবিহীন মানিব্যাগসহ
বিত্তহীন তোমাকে।
কবিতার তুমি, মালকোষ রাগের ভেতর
ডুবে থাকা তুমি,
এলোমেলো বিক্ষিপ্ত তোমাকে।
তোমার চোখ দুটো সমুদ্র
আঙুলগুলো রংতুলি,
সাত সকালের কুয়াশার মত
ঠান্ডা তোমার কপাল
শুধু ভাবনাগুলো তপ্ত পিচঢালা পথ।
আজ আঁকবো তোমায়
পুরোনো সাইকেল
হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি
আর শান্ত সুবোধ
র চায়ের কাপ হাতে তোমাকে।
তোমাকে আঁকবো
গ্রাফাইট পেন্সিলে, কাঠকয়লায়
লজ্জার আবছা রঙে
স্পঞ্জ লাল ফুসফুসে
হৃদপিণ্ডের খুব কাছেই।
সান্ধ্য গল্প
নাজনীন চৌধুরী
দিন যেমন তেমন কাটে
মধ্যরাতে আচমকা জেগে উঠি
হুড়মুড় করে
মনে হয় কে যেন ডেকে গেলো চেনা গলায়
আজকাল আর আগের মতো মনে পড়ে না অনেক কিছু
চকের সেই বাবলা গাছের বাঁকানো ডাল ধরে গল্প করা
গাঁও গেরামের কিশোরী আবদার দুই পয়সার টানা
খাওয়া, লাল-হলুদ স্যাকারিন দেওয়া আইসক্রিম খাওয়া
না কিছুই আর সামনে আসে না।
এপাড়া ওপাড়া টইটই করে ঘুরে বেড়ানো
আজ মনে করলে নিজেই হাসি
কতো বকুনিঝকুনি মায়েরÑ তারপরও স্নেহের আঁচলের
কোনা ধরে মধুর ক্লান্ত ঘুম বেঘোরে!
এখন সান্ধ্য গল্প হয় চায়ের কাপে চুমুকের
অবসরে
সে গল্পে শুধুই নিজেকে নিয়ে।
ত্রিধা
পারুল কর্মকার
ক্রমশ একটি ঘূর্ণায়মান চক্রে প্রবাহিত হচ্ছে
সৃষ্টি-স্থিতি এবং আত্মসিদ্ধির গতি।
কিছু গল্প থেকে বিচ্ছুরিত হয় হীরক দ্যুতি,
কিছু গল্প থেকে বিচ্ছুরিত হয় নোনা-কাদা-জল।
এখানে কতোজন আসে-যায়,
করো সাথে সম্পর্ক তৈরি হয়
আবার ভেঙেও যায়।
বোধনের ঘন্টা বেজে ওঠে
আমি শীত কুয়াশায় জড়িয়ে নেই
জনজীবনের এলোমেলো কথা।
নিঃসঙ্গ কথারা চুপটি করে
গেঁথে থাকে কবিতার খাতা।
আর তুমি! সমস্ত কৌণিক বিন্দু জুড়ে
এঁকে দিচ্ছো একটি চিত্রকলা।
‘ত্রিধা’ তবে এসোÑ
ত্রিবেণী সঙ্গম শেষে
কিছু স্বপ্নে তুলে আনি নীলাদ্রি গভীরতা।
তুমি তার বিশালতায় ভাসো
আমি তার রূপরেখা খুঁজি।
মানুষ
রুবাইদা গুলশান
ইচ্ছে করে মায়ার খেলায় আলোর ছায়ায়
যাই উড়ে যাই চুপটি করে
বাঁধনহারা প্রজাপতির রঙিন ডানায়।
নরম মেঘের আলতো ছোঁয়ায়
যাই ভেসে যাই দূর অজানায়।
যেই খানেতে নীলচে মেঘের গল্প জমে দূর পাহাড়ের গায়ে গায়ে
যেইখানেতে ভিড় করে রোজ লালচে সাদা মেঘের মেয়ে।
সেই মেয়েটির হাসির সুরে
যাবো ভেসে দূর থেকে দূর আরো দূরে!
কী যেন নেই, কী যেন নেই ভেবে ভেবে
হঠাৎ পথে
একটু থেমে আসবে তুমি আমার মনে।
দেখব তখন পেছন ফিরে
একলা আমি যাচ্ছি ভেসে
যাচ্ছি উড়ে অনেক দূরে, আসছে ভোর, আসছে সকাল,
দেখছি বিকাল এই তো জীবন কাটছে এমন।
যাচ্ছি আমি অনেক দূরে,
সূর্য তখন ফিরলে ঘরে,
সেই মেয়েটির এলোচুলে সন্ধ্যা এলে ভয় পেয়ো না,
আবার আমি আসবো ফিরে
তোমার কাছে মানুষ হয়ে।