গুলশান-২, ঢাকা, বাংলাদেশ   Friday,19 April 2024

কবিতা

about1

দেয়াল

ফারুক মাহমুূদ

 

দেয়ালের কান আছেÑ এমন প্রবাদ

                          আমাদের সকলের জানা   

ওর-ও যে চোখ-পিঠ আছে

                            সে-কথা খুব বিদিত নয়।

 

তাচ্ছিলে উড়িয়ে দিই দেয়ালের বেদনা-পাহাড়

চোখের জলের দাগ ঢেকে দিই অবজ্ঞার চুন-কালি দিয়ে

 

দেয়ালের পিঠÑ সে তো কেনা দাস নয়Ñ

শব্দহীন সয়ে যাবে অবিরাম বুটের আঘাত

দেয়ালের চোখÑ সে তো চিরঅন্ধ নয়Ñ

অশ্রুস্রোতে ঢেলে দেবে প্রাণঘাতী বিষ

 

খাদের কিনারে পৌঁছে, জন্মমৃত্যু এক হয়ে গেলে

দেয়ালের পিঠ জুড়ে জন্ম নেয় আগুনের গাছ

        প্রতিটি তাকানো যেন রুদ্রবজ্রপাত

 

একাত্তরে আমাদের তা-ই হয়েছিল

 

প্রতি ইঞ্চি মাটি যেন গর্জে ওঠা দেয়ালের পিঠ

চোখে কোনো অশ্রু নেইÑ রক্তদ্যুতি, বারুদের ক্রোধ

 

যুদ্ধে যুদ্ধে স্বাধীনতা, সত্য হলো বিজয়ের গান

 

 

 

সভা নেই, জনগণ

জাফর ওয়াজেদ

 

খেয়া ঘাটে মাঝি বসে আছে বৈঠায় হাত

পড়ন্ত বিকেলের সাথে গঞ্জে যাবে যারা

অথবা দুপুরে আসে যারা দূরযাত্রা শেষে

তাহাদের খেয়া ঘাটে বসে মাঝি শেষ গলুইয়ে

কৃষি জমি চাষহীন জলাভূমি যেন শুয়ে বিকৃত

ষ্পর্শ নামেনি দেহে কোনদিন কর্ষিত ছোঁয়ায়

বুকের খাঁজে রক্তিম রোদের ভিন্ন চুম্বন জাগে

দূরাকাশের জ্বলজ্বল নক্ষত্রের ঘোলাটে জলোচ্ছ্বাসে।

 

অথচ ছিল দিন উৎসবের, পরবের রজনীও

দল বেঁধে ভোর রাত নদী তীরে কুয়াশা ঘ্রাণ

নদীতে দল বেঁধে মাছেদের প্রিয় সাঁতার

রোজ জটলা বেঁধে ধরা দিত জালের গরাদে

জোৎস্নারাত ধ্বনি দিত দেহ মনে উত্তালে

 

বিকেলের মাঠে সমবেত মানুষের দল

কখনো সমস্বরে কখনো চিৎকারে মেলাতো কণ্ঠ

মুক্তির উদ্যানে সমবেত হাতের বাজাতো ডংকা

ঐকতান মূর্হুমূহু সংগ্রামে নাচাতো মন প্রাণ

 

দূর শহর থেকে শব্দ এসে যেতো দ্রোহের

জেলের জাল থেকে সড়াৎ করে নেমে যেতো মাছ

উঠোনে মাঠে এসে যেতো তরুণের গলা

দাবির মতো সোচ্চার মন্ত্রের মতো জোরালো

সুগভীর রোদের মতো আন্তরিক সময়

অন্নবস্ত্র-গৃহহীন জীবনের চরম উচ্ছেদে

ক্রমশঃ মাতাল চাঁদের মতো কখনো গুলি মিছিলে

রক্তের নদী বেয়ে গড়াতো পুকুরের জালে

জনসভা ধ্বনিত মিছিলের প্রকম্পিত উত্থানে

মুক্ত স্বপ্নের সাহসী জীবনের ভাষা হতো।

 

রোদ নেমে বৃষ্টি আসে, খেয়া ঘাটে বসে মাঝি

পারাপার নেই, যাত্রীও আসে না আর

গঞ্জের মানুষ সব কোথায় থমকে আছে

জনসভা নেই কোথাও, জনগণ নামে না মিছিলে

স্বপ্নহীন পারাপারহীন ঘৃণিত জীবনের ধারে

সব ঝরে গেছে সভাহীন স্লোগানের ঘায়ে-

 

 

একলা মানুষ চাই

নাসরীন নঈম

 

তোমাকে অচেতন করে তবে কাছে নেব

আমি একাই তোমাকে ছোঁব

তুমি ছোঁবে না

তুমি জানবেও না আমি ঠিক

তোমার শরীরের কোথায় কোথায়

হাত রেখেছিলাম

আলতো করে ভালোবেসেছিলাম

বিছানা ছেড়ে মেঘের মতো উড়েছিলাম।

 

তুমি তো গৃহী মানুষ

যুগলে হাঁটো, যুগলে ঘুমাও, যুগলে চা খেতে যাও

আমার দিকে হাত বাড়াবে না

শুধু গোলাপ সখা হয়ে থাক।

 

আমি একজন একা মানুষ চাই

পবিত্র, স্নিগ্ধ অপাপবিদ্ধ যার চোখের চাওয়া

আগুন হয়ে আমাকে পোড়াবে

আমি একাই পুড়তে পুড়তে ছাই হবো।

 

তুমি শুধু দেখতে থাক কীভাবে

পৃথিবীর ঊর্ধ্বে কোনো নক্ষত্র আমাকে

কাছে টেনে নেয়।

 

 

চারটি অণু কবিতা

কাজল চক্রবর্তী

 

পৃথক ধর্মে

জলে ছিলো বসবাস কমল ও শাপলার

জমি ভাগ হলো জলভূমি তোলপাড়

ফুলের ধর্ম ছেড়ে এখন দেখি জলজরা

অধর্মে শ^াস নিচ্ছে, খুনোখুনির হাহাকার।

 

অপ্রকাশ্য ঋণ

অবলুপ্ত হয়ে গেছে পঞ্চম চরণ

হয়তো বা ছোট হবে আরো পরিসরে

মিটে যাবে জীবনের অপ্রকাশ্য ঋণ

ভালোবাসায় ভাসুক তোমার জন্মদিন।

 

 

পাউরুটি

হাত নড়ে পা নড়ে এখনো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা টানটান

কপালের ভাঁজ দেখি, গলায় অনেকগুলো বেড়ি

বয়েস বেড়েই যায়, শঙ্কায় ভাবছো তুমি, এই মুড়ি

যদি মুচমুচে না হয়! শঙ্কামুক্ত হয়ে বলো, পাউরুটি দিন।

 

কিছু মিলবে না

শোন ঘুরে দাঁড়া ওপথে যাস না আমাদের মতো

মেঠো গরিবের রেডিমেড ক্যাশ অথবা কাইন্ড

কিছু মিলবে নাÑ এই ভারতের সব গরিবেরা

তেমনি থাকবে যেমন দেখেছি আজাদীর আগে।

(পশ্চিমবঙ্গ, ভারত)

 

 

ডাক

মাহমুদ হাফিজ

 

কোথায় সে আজ সাত সাগরের মাঝি

কত যে নাবিক ছুটে চলে পাল তুলে

মনজিলমুখী, জীবনটা রেখে বাজি

দেখলে না তুমি হাল টেনে গেলে ভুলে।

 

স্বপ্ন তোমার বুকে, হাতে ধরা হাল

খেয়া ছুটেছিল  সামনেই বন্দর,

রাত শেষ হলে আলো দেখা দিত কাল

কেটে যেত বুঝি অন্ধকারের ঘোর।

 

হাল টেনে টেনে হতাশায় গেলে ডুবে

নতুন সফরে পথের হলো না শেষ,

রাত পোহাল না, ফুটল না আলো পূবে

দেখলে না মাঝি স্বপ্নের গড়া দেশ।

 

দরিয়ার ডাক: মাঝি ফিরে এসো ফের

রাত শেষে আজ বেলা উঠে গেছে ঢের।

 

 

 

ইঁদুর বিড়াল বিষয়ক

মুজতাহিদ ফারুকী

ইঁদুরের উৎপাত বেড়েছে কিচেনে।

একটা বিড়াল দরকার।

ঘরের হুলোটা ফুলবাবু, পড়ে পড়ে ঘুমায় ঝিমায়

কোথায় কোথায় যায়, কোথায় লাগায় জিভ চোখ

বেহদিস, হতে চায় নাকি বুদ্ধিজীবী!

খুঁজি তাকে ব্যালকনি, করিডোর, ভয়েডের গলির ছায়ায়

কোথাও দেখি না; তার চাই অধিক গোপন

চাই আরও ঘনিষ্ঠ আঁধার

ও বাড়ির মেনিটার সাথে খুব ভাব, গলাগলি

তোলা তোলা পেয়ে কবে ভুলেছে শিকার!

একটা বিড়াল দরকার।

গিন্নীর আলটিমেটাম ঝোলে ঘাড়ে।

 

 

আমি

কামরুজ্জামান

 

প্রতি প্রত্যুষে আমার আমি থেকে একটি একটি করে

অহংকারের পালক খুলে খুলে নিক্ষেপ করি -

কামারশালার হাপরের নীলাভ শিখার অগ্নিকুন্ডে

পুড়ে পুড়ে ছাই ভস্ম হয়ে মিশে যায় আকাশে-বাতাসে

আমিকে নিয়ে যাই তুচ্ছাতিতুচ্ছ কর্মের বিবরে

মানুষ কত অসহায় পড়ে আছে রাত্রির উদরে।

 

দিন শেষে আবার ভেতরে ক্রমে ক্রমে বেড়ে ওঠে

বহু বর্ণীল অহমের লতাগুল্ম বৃক্ষ ডালপালা

মোহ মায়াজাল ফেলে চৈতন্যে নিয়ে আসে

কাম ক্রোধ মাৎসর্য বিত্তবৈভব যাবতীয় লিপ্সা।

 

ছুটে আসে স্বপ্নের ঘোড়া, সোনালী মায়ামৃগ

একটি করে ডিম পারে সোনার রাজহাঁস।

রাজকন্যা ডালিমকুমার, লাইলী মজনু

ইউসুফ জুলেখা, মারমেইড, রুমিও জুলিয়েট

ঝকমক করে ওঠে রাজ প্রাসাদ রাজপুত্র

সিংহাসন যুদ্ধবিদ্যা রণকৌশল রক্তপিপাসা...

 

অন্ধকার থেকে আমিকে আবার নিয়ে আসি

আপন ঘরে আবার এক এক করে পালক

বিচ্ছিন্ন করে ছুড়ে দেই লেলিহান শিখায়

নিমিষেই ছাই ভস্ম হয়ে উড়ে যায় বাতাসে

তারপর আমিকে নিয়ে যেতে থাকি আলোর দিকে...

 

 

মনের গহিনে অবহেলা

রকিবুল হাসান

 

এতটা কিভাবে পারো তুমিÑআমাকে বঞ্চিত করে

একমুঠো স্নেহ কেড়ে নিয়ে বিলিয়ে বেড়াও

দূরের অচিন স্বার্থেÑসাদাসিধে রূপালী রঙের

বুকের মরম কতোটা মমতা নিয়ে দূর বহু পথ ভেঙে

এসেছিল আমার জন্যÑতুমি তা মূল্যহীন করে

ছড়িয়ে দিয়েছ স্বার্থের হিসেবি হৃদয়হীন অংকে।

 

এই মমতা যায় না অর্থে কেনাÑতুচ্ছতাচ্ছিল্য করে

ফেলে দেয়া যায় না স্নেহের পবিত্র পরশ। কীভাবে যে

কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত থেকে মুঠো ভরে আনা

কতো ভালোবাসা তুমি উড়ালে যে কতো জনে।

 

আমাকে তোমার মনে হয়নি কখনো কিছুতেই;

কী অদ্ভুতÑ ভালোবাসার গল্প শোনাও

তোমারই রক্ত আমিÑকী শান্তি তোমার আমাকে

ভালোবাসার বিলাসী গল্পে মনের গহিনে অবহেলা গেঁথে।

 

 

ভুল হিসেবের কাল

ফরিদ ভূঁইয়া

 

খেদ থেকে জেদÑ পুষতে ভালোই জানো

 

জেদ ফেটে অঙ্কুরিত হলে

ভেদজ্ঞানে তোমায় কী নামে ডাক দেবো?

 

গোমরা মনের ঘুম— আঁধারের চুম;

আলোক দিনের সূর্য গেলো চুরিÑ তুমি অপরাধী

 

প্রতিবাদে ক্রুদ্ধ চোখে নক্ষত্র অযুত

সৌর সভায় মিলেছে আজ;

তাদের বিম্বিত ক্ষোভ আমার ভেতর

ক্ষোভ থেকে খুব ঝড়, বইছে অফুরান!

 

তক্কে-সখ্যে যাপন জীবন, ভুল হিসেবের কাল;

ঘি বিকিয়ে তামাক খরিদ, বাড়ছে ভুলের দিন

খামখেয়ালির দিনÑ এক, দুই, তিন

 

খেদ থেকে জেদÑ পুষতে ভালোই জানো!